Wednesday, July 15, 2015

প্রসঙ্গঃ বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর আস্থা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম
বাংলাদেশের সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' ও 'আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস' সংযুক্ত করেছেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এই পরিবর্তন হয়েছিল ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে। উভয় রাষ্ট্রপতি জনসংখ্যার শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েই যে এ যৌক্তিক পরিবর্তনগুলো করেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমাদের দেশের কিছু সুশীল (?) মনে করেন, সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম', 'আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে নাকি এদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও নাকি বারোটা বেজে যাবে। '(সাবেক) প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তার চরম বিতর্কিত মুন সিনেমার মালিকানা সংক্রান্ত মামলার রায়ে লিখেছেন, ''By the said martial law proclamations, the secular Bangladesh was transfromed into a theocratic state and thereby not only changed one of the most basic and fundamental feathures of the constitution but also betrayed one of the dominant cause for the war of libaretion of Bangladesh.''
(উল্লিখিত সামরিক ফরমান বলে ধর্মনিরপেক্ষ বানলাদেশকে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে এবং আর ফলে কেবল সনবিধানের মূলনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যেরই পরিবর্তন সাধন করা হয়নি, অধিকন্তু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রধান উদ্দেশ্যের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।) প্রধান বিচারপতির দাবি অনুযায়ী সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এবং 'আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস' সংযুক্ত থাকাতেই বাংলাদেশ একটি ধর্মতান্ত্রিক(পড়ুন মৌলবাদী) রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। [সূত্র, জেল থেকে জেলে- মাহমুদুর রহমান, পৃষ্ঠা-২৮৮] তিনি এখানে 'but also betrayed one of the dominant cause for the war of libaretion of Bangladesh' বলে বুঝাতে চেয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতা। অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করা, সেই ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। ভণ্ডামিরও একটা সীমা থাকা দরকার!
২০১১ সালের ২ জুন আওয়ামী লীগের ছায়াসংগঠন 'সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের' অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যাখ্যা করে বলেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নাকি বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে হয়েছে। ঐদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেওয়া হবে। (দৈনিক আমারদেশ, ১০ আগস্ট ২০১১ইং) এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে একই মাসের ৩০ তারিখ (২০১১ সালের ৩০ জুন) সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণ করে সংবিধানের মূলনীতি থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হয়। (দৈনিক আমারদেশ, ১০ আগস্ট ২০১১ইং) এই সংশোধনীতে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এর অর্থ লেখা হয়েছে- 'পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে আরম্ভ করছি।' এখানে আল্লাহ শব্দের বিকল্প হিসেবে সৃষ্টিকর্তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এটি 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এর বিশুদ্ধ ও যথার্থ অনুবাদ নয়। এখানে 'রহিম' শব্দটির তরজমা করা হয়নি। 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' এর সঠিক অনুবাদ হচ্ছে- 'পরম করুণাময়, চিরদয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।' এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল- রহমান, রহীম শব্দগুলোর বাংলা তরজমায় সমার্থবোধক বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে কিন্ত আল্লাহ শব্দের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা বা অন্যকোনও শব্দ ব্যবহারের সুযোগ নেই। এটা অর্থগত বিকৃতি। ইসলামের দৃষ্টিতে এরকম অর্থ বিকৃতিসাধন চরম গর্হিত কাজ। আল্লাহ শব্দটি বাদ দেওয়ার কারণ হয়ত এটি হতে পারে- পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ' আর যখন শুধু এক আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয় তখন যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয়ে যায়। আর যখন আল্লাহর পরিবর্তে অন্য উপাস্যগুলোর উল্লেখ করা হয় তখন তারা আনন্দে উল্লসিত হয়। [সূরা- জুমার, আয়াত-৪৫] এই আয়াতের শেষাংশের সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দারুণ সাযুজ্য! ২০১১ সালে তিনি যখন ঢ়াকেশ্বরী মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশন পরিদর্শন করেছেন, তখন হিন্দুদের খুশি করার অতিশয্যে বলেছিলেন- 'আমরা জানি এবং শুনেছি মা দুর্গা প্রত্যেক বছর কোন না কোন বাহনে চড়ে আমাদের এ বসুন্ধরায় আসেন। এবার আমাদের দেবী এসেছেন গজে চড়ে। জানি, গজে চড়ে এলে এ পৃথিবী ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে- তা আমরা দেখতেই পচ্ছি। এবার ফসল ভাল হয়েছে।'(দৈনিক আমারদেশ, ১২ অক্টোবর ২০১১ইং) প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিতে তার ধর্মবিশ্বাস কোথায় গেছে, সে বিবেচনার দায়িত্ব মুফতিদের উপর ছেড়ে দিলাম। এখানে একটি বিস্ময়ের ব্যাপার হল- সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'বিসমিল্লাহর' অর্থ বিকৃতিসাধন ও 'আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস' বাদ দেয়া হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঠিকই বহাল আছে। এটা কি তাহলে দুরভিসন্ধি! আল্লাহ মালুম!
তথাকথিত এসব সুশীল যে জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি বা মিথ্যাচার করছে, তা এদেশে আর কেউ করেনি। তারা যে মিথ্যার বেসাতি সাজিয়েছেন তার কোন তুলনা হয় না। যেসব সুশীল (?) একাত্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলে দাবি করেন, তাদের এ দাবি বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও নির্জলা মিথ্যা। আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৭০ সালে দলটির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অথবা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্রে কোথাও কি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি খুঁজে পাওয়া যাবে? মূলত এ বাক্যটি সংবিধানে লিখে ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে যারা 'শহীদ' হয়েছেন তাদের আত্মাকে কষ্ট দেওয়া হয়েছে। তথাকতিত সেসব সুশীল আরো দাবি করছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও নাকি ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। এটি নিতান্তই সত্যের অপলাপ। মুক্তিযোদ্ধাদের যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ জরিপ চালালেই তাদের এ অন্তঃসারশূন্য দাবির মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল তা 'শহীদ' শব্দের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ থেকেই সুস্পষ্ট। ইসলামই তো অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ছিল। কেননা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামই সবচে বেশি সোচ্চার। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে জুলুমের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। এমনকি জুলুম প্রতিরোধে ইসলামে জিহাদের বিধান রাখা হয়েছে। ইসলামের এই বিধানই ধর্মপ্রাণ মানুষের শিরায় শিরায় জ্বালিয়ে দিয়েছে প্রতিরোধের অগ্নিশিখা।
সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করছেন তাদের মধ্যে ৯৮ ভাগ ছিলেন মুসলমান, আর মৃত্যুভয়ে যারা এদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৫ ভাগ ছিলেন হিন্দু। সুতরাং এই ৯৮ ভাগ মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী ছিল বলে কেউ যদি দাবি করেন, তাহলে তা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। চরম সত্য হল, সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ধর্মনিরপেক্ষতা কী তা জানতেন না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালে এদেশের মুসলমানরা ইসলামী চেতনায় জেগে ওঠে জালিমের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং 'শহীদী মৃত্যু'র তামান্নায় নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল। যারা চার দশক পরেও নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবিষ্কারে গলদঘর্ম তাদের জন্য- ধিক! শত ধিক!
ইসলামই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল তার প্রমাণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) এম এ জলিলের 'অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' নামক বই থেকে উদ্ধৃত করছি- 'ইসলাম মুক্তি এবং শান্তির এক বিপ্লবী ঘোষণা। স্বাভাবিক কারণেই ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পক্ষের শক্তি। মানুষের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে ইসলাম প্রতিবন্ধক তো নয়ই, বরং যুগান্তকারী এক সহায়ক শক্তি- মূলশক্তি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে একমাত্র প্রভু ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইসলাম মানুষকে মূলত স্বাধীন করে দিয়েছে। এই স্বাধীন মানুষের উপর একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ব্যতীত যে কোন ধরণের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলাম আপোসহীন জিহাদ ঘোষণা করে। এমন একটি জীবন দর্শন যা চূড়ান্ত অর্থেই পরিপূর্ণ, সেই ইসলাম সম্পর্কে যারা অসহিষ্ণু মনোভাব প্রদর্শন করে, তা তারা অজ্ঞতাবশতই করে বলে আমার বিশ্বাস। (পৃষ্ঠা-৭৩)
দৈনিক আমারদেশের কারাবন্দী সম্পাদক মাহমুদুর রহমান একটি চমৎকার কথা বলেছেন- ' ইসলামী চেতনা ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, ইসলাম ত্যাগ করলে এদেশ স্বাধীন থাকবে না। বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হলে এই রাষ্ট্রটির স্বাধীন অস্তিত্বের ভিত্তিই যে তৈরি হতো না, এই চরম সত্য যারা ৪২ বছর অস্বীকারের চেষ্টা করে চলেছেন, তারা শুধু চরম ইসলামবিদ্ধেষীই নন, একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতারও শত্রু।' [মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই- মাহমুদুর রহমান, পৃষ্ঠা- ১৯]
সংবিধানে 'বিসমিল্লাহ', 'আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে যদি এদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাহলে আওয়ামীপন্থী তথাকথিত সেসব সুশীলদের কবুল করতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলন এবং এখনো তিনি একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী। কারণ, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এখনো বহাল আছে। আর এটাও মেনে নিতে হবে যে, সেই সময়কাল ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারেন নি। কিন্তু, বাংলাদেশের বাস্তবতা কি তাই বলে? বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সুশীলদের (?) একটি তথ্য জানানো আবশ্যক। ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ যে দেশ থেকে আমদানী হয়েছে, সেই যুক্তরাজ্যের রাণীর একটি দীর্ঘ সরকারী টাইটেল রয়েছে। দীর্ঘ সেই টাইটেলটি শেষ হয়েছ 'Defender of protestant faith' (খ্রিস্টান ধর্মের একটি শাখা প্রটেস্টেণ্টের রক্ষক) বাক্য দিয়ে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান দুটো ধারা হচ্ছে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টেণ্ট। টাইটেল অনুযায়ী রাণী কেবল প্রটেস্টেণ্ট ধর্মরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এতে সে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা গেল গেল বলে রব উঠছে না।
ইউরোপ, আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম আছে। যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলেও প্রেসিডেন্টকে বাইবেল ছুঁয়ে শপত নিতে হয়। যুক্তরাজ্য ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সরকারিভাবে রাণী প্রটেস্টেণ্ট ধর্মের রক্ষক। সুইডেন একটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু সুইডেনের রাষ্ট্রধর্ম আছে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলেই যদি বাংলাদেশ মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয় , তাহলে উল্লিখিত দেশগুলো মৌলবাদী রাষ্ট্রের ব্র্যাকেট বন্দি হবে না কোন যুক্তিতে? আমেরিকার সরকার ও জনগণ যেখানে তাদের মুদ্রার পিঠে লিখে দেয়- In God we trust (আমরা আল্লাহকে বিশ্বাস করি), সেখানে আমাদের সংবিধানে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর আস্থা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সন্নিবিষ্ট থাকলে গাত্রদাহ হচ্ছে কেন? ক্ষমতাসীন এবং তাদের পদলেহী সুশীলরা (?) প্রায়ই হুঙ্কার দিয়ে উঠেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আর ধর্মকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। অথচ তারাই ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের আগে মৌসুমি ধর্ম পালন, হেজাব-তসবীহ ধারণ এবং শাহজালালের দরগা যিয়ারতসহ বকধার্মিক সাজার যত আয়োজন প্রয়োজন তার কিছুই হয়ত বাদ যায় না। তখন ধর্মনিরপেক্ষতার 'মহান আদর্শের' কি কোন ক্ষতি হয় না?
আসলে ক্ষমতাসীনরা সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম মুছে দিয়ে এদেশের মুসলমানদের হৃদয় থেকেও আল্লাহর নাম মুছে ফেলতে চাইছে। কিন্তু তা কিছুতেই সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'ওরা মুখের ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় আল্লাহর আলো, আর আল্লাহ অবশ্যই তাঁর আলোকে পরিপূর্ণ করে ছাড়বেন। যদিও তা অবিশ্বাসীদের জন্যে অপ্রীতিকর হোক। তিনিই তাঁর রাসুলকে হেদায়েত ও দ্বীনে-হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এ সত্য দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন। তা মুশরিকদের জন্যে যতই অপ্রীতিকর হোক। (সূরা, সাফ-৮-৯) ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিমোহিত হয়ে যারা আমাদের সংবিধানের মূলনীতি থেকে 'আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস' অংশটি নির্দ্বিধায় উঠিয়ে দেয়ার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তারা ফেরাউন ও নমরুদ আল্লাহর নাম মুছে ফেলতে গিয়ে যে শিক্ষা পেয়েছে, তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম মুছে ফেলার যে দুঃসাহস প্রদর্শন করেছেন, তা আগুন নিয়ে খেলা করার শামিল। আর আগুন-খেলার পরিণতি হয় ভয়াবহ। মনে রাখবেন, 'আপনার প্রভুর পাকড়াও বড়ই কঠিন।'(সূরা, বুরুজ-১২) বেমালুম ভুলে গেলে চলবে না, চিরদিন এ ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না। একদিন না একদিন তা ছাড়তেই হবে। তখন জনগণের সম্মুখে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কুকীর্তির জন্যে নিক্ষিপ্ত হতে হবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। সর্বোপরি জীবন-প্রদীপ যখন নিভে যাবে তখন তো মহান আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে প্রতিটি পাই-কড়ির।
সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে 'আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস' বাদ দেওয়ার কারণে সামান্য কিছু মৌখিক প্রতিবাদ হয়েছে। এরপর এদেশের মুসলমানরা একেবারে নির্বিকার। এদেশের নির্জীব মুসলমানদের কাপুরুষতা দর্শনে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি আসলেই মুসলমান নাকি নামধারী মুসলমান? আল্লামা ইকবাল আমাদের মতো মুসলমানদের বলেছেন-
'হার কোয়ী মাসতে মায়ে জাওকে তন আসানী হায় / তুম মুসলমাঁ হো? ইয়ে আনদাজে মুসলমানী হায়?'
(আজ তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তিই আরাম-আয়েশে লিপ্ত। তোমরা কিসের মুসলমান? এটাই কি মুসলমানের শান?)
অনেকেই মনে করেন, প্রতিবাদ শুধু হুজুররা করলে চলবে। না, তা নয়। এই প্রতিবাদহীনতার কারণে প্রতিটি মুসলমানকে জবাবদিহি করতে হবে কাল কেয়ামতের ময়দানে। শেষ কথা হল, সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। এ সরকার ইসলামকে এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেছে। সুতরাং আর কালক্ষেপণ নয়, এদেশের সমস্ত মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের ইসলামবিরোধী সকল কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে হবে। তা না হলে, আমরা যদি নীরব ভূমিকা পালন করি, তাহলে তা হবে ইসলামের প্রতি আমাদের চরম অবজ্ঞা।

Sunday, July 12, 2015

দেশে অপরাধ বৃদ্ধিতে আল্লামা আহমদ শফীর উদ্বেগ

দেশে খুন, গুম, অপহরণ, অপমৃত্যু ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই ছিনতাই, অপহরণ, খুন ও ডাকাতির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নিজের বসত ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, কোথাও কারো নিরাপত্তা নেই। রাজপথে, হাসপাতালে, নদীতে, ডোবা-নালায় পড়ে থাকছে মানুষের লাশ। এক দিকে আইন-শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ অবনতির দিকে যাচ্ছে দিন দিন, অন্যদিকে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, আগ্রাসী মনোভাব, লোভ ও একমুখী স্বার্থপরতা অশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন নিরাপত্তাহীন ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ চলতে থাকলে দেশের সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
রবিবার বিকেলে এক বিবৃতিতে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী।

বিবৃতিতে আল্লামা শাহ আহমদ শফি বলেন, দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত থাকলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা যেন দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সেই সাথে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, কলহ, আত্মহত্যা, হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী বেড়ে চলেছে। এসব ঘটনায় আমাদের সামাজিক অস্থিরতা, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা এবং নৈতিক অবয় যে বেড়েই চলেছে তা সহজেই অনুমান করা যায় । একটা স্বাধীন দেশে, সভ্য সমাজে এ ধরনের হানাহানি ও মৃত্যুর মিছিল মেনে নেয়া যায় না। বর্তমানে সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রতিদিন যে হারে খুন, গুন, অগ্নিকান্ড, দূর্ঘটনায় অপমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়, তাতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সামান্য স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলে বা তুচ্ছ তর্ক-বিতর্কে খুনাখুনির মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে গিয়ে প্রতিশোধ পরায়ণতা বেড়ে চলেছে। সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো যেন ভেঙ্গে পড়ছে। কেউ কারো কথা শুনতে ও মানতে চায় না। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় ও আদর্শিক মূল্যবোধ দেশ ও সমাজ থেকে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো ভঙ্গুর হয়ে পড়বে।
বিবৃতিতে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এসব অপরাধ ও অন্যায় প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও কার্যকর তৎপরতা চোখে পড়ে না। তারা সর্বদাই সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের প্রটোকল এবং বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচি ঠেকাতেই ব্যস্ত রয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপ দমনে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে পুলিশের এক শ্রেণীর সদস্য ও কর্মকর্তা ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলে লিপ্ত হয়ে পড়ার খবরও পত্রিকায় দেখা যায়। এ কারণেই সারাদেশে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-অপহরণ ও চাঁদাবাজি বেড়ে চলেছে। এ ধরণের নিরাপত্তাহীন পরিবেশের কারণে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও বিনোয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। যা দেশ ও জাতির জন্য কোনভাবেই সুফল বয়ে আনবে না।

বিবৃতিতে হেফাজত আমীর বলেন, দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার এই অবনতি ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশের জন্য শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা নয়, বরং এর দায় চূড়ান্ত বিবেচনায় সরকারও এড়াতে পারবে না। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীসহ নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রায় নিয়োজিত সকল বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্সের অর্থে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানই তাদের মূল দায়িত্ব। পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করে, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা রার মূল দায়িত্বে সঠিকভাবে ব্যবহার করলেই কেবল পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। তিনি বলেন, এমনিতেই দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা চলছে দেশে। আইন-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার অবনতি অর্থনৈতিক মন্দাকে যেমন দীর্ঘায়িত করবে, সেই সাথে জনঅসন্তোষও বাড়িয়ে তুলবে। রাজনৈতিক অস্থিরতাকে পুঁজি করে পেশাদার অপরাধীরা তাদের অপতৎপরতা বৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে গুম-খুন, অপমৃত্যু রোধ ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যথাশীঘ্র কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী। এ েেত্র সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ দেখতে চায় জনগণ।
তিনি আরো বলেন, আইনের নিরপেক্ষ কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি দেশ ও সমাজ থেকে অন্যায় ও অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। সাধারণ মানুষকে নিয়মিত নামায আদায় ও ধর্মীয় শৃঙ্খলা মেনে চলা এবং নারীদেরকে বাইরে যাওয়ার সময় পর্দা ও শালীনতার সাথে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কারণ, ধর্ম মানুষকে ন্যায় ও ইনসাফের পথে চলতে এবং অন্যায় ও হানাহানি থেকে দূরে রাখতে কঠোরভাবে উদ্বুদ্ধ করে। ধর্ম মানুষকে খুনাখুনি, মদ-গাঁজা, দূর্নীতি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়তে বাধা দেয়। দেশ ও সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা বেড়ে গেলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আপনা থেকেই কমে যাবে। তিনি সরকারীভাবে বিভিন্ন মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম ও নৈতিকতার উপর প্রচারণামূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।